আমাকে একটা ‘শান্ত’ দাও/ ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ দিবো!
সাইফুল বিন হানিফ
করোনা তুমি এ কেমন মৃত্যু দিলে যে, প্রিয়জন’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারি না। শেষবারের মত স্পর্শ করতে পারি না। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। আমি চিৎকার করা ভুলে গেছি। সান্তনা নেয়া বা দেয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে ফেলেছি আমার পিতৃতুল্য সহযোদ্ধা দেশের দ্রুততম কুরিয়ার সার্ভিস ‘সুন্দরবন’ লিঃ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান’কে।
‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার / ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা!
ও কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার’
কর্মমূখী, সৃজনশীল, সাংস্কৃতিক ও কারিগরি শিক্ষার পথিকৃৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত বাঙ্গালি জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে বুড়িগঙ্গায় সলিল সমাধি হয় তাঁরই এগারোজন সহযোদ্ধার। সন্তান-সন্তুতি না নিয়ে বন্ধুদের আত্মার শান্তি ও দেশ গড়ার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর মা বলতেন- যুদ্ধ শেষে সবার ছেলে বাড়ি ফিরে, তুমি ফিরবে কবে বাবা? সেদিন স্বপ্নবাজ শান্ত উত্তর দিয়েছিলেন- যুদ্ধ শেষ করেই বাড়ি ফিরবো। আমার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়’নি মা।
শত স্বপ্ন, আত্মীয়-স্বজন, অসংখ্যগুণগ্রাহি, শান্ত-মারিয়াম পরিবারের হাজার হাজার সন্তান’দের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন আমাদের প্রিয় শান্ত স্যার।
তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ি বাবা-মায়ের কবরের পাশে বনানী কবরস্থানে সমাধিত হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত।
১৯৭৫’র জাতির পিতার হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হারিয়েছিলেন সহযোদ্ধাদের। সামরিক সরকারের প্রচণ্ড চাপে দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে জার্মানি যান এবং নতুনভাবে জীবন ও দেশ গড়ার ব্রত নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন ব্যবসা। একে একে প্রতিষ্ঠা করেন অসংখ্য সেবামূলক-মানব কল্যাণমূখী প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় ‘ডাক ও তার’ মন্ত্রাণালয় উপাধি দেয় ‘ লিজেন্ড অব কুরিয়ার’ ।
অত্যন্ত পরিশ্রমি, বিনয়ি, স্বপ্নবান মানুষ ছিলেন তিনি। কাউকেই খালি হাতে ফিরাতেন না। তাই তাঁরই বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান দিলু বলতেন- কেউ ফেরে না খালি হাতে/ শান্ত বাবা’র দরবারে।
তাঁর সাথে রয়েছে আমার অসংখ্য স্মৃতি। কখনো অকাতরে বলতেন- স্বপ্নের কথা, দেশ গড়ার কথা। কতকথা। কত মান-অভিমান ছিল তাঁর সাথে। অসম্ভব উদার মনের মানুষ ছিলেন। পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে রাখতেন। মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে বলতেন- তুই তো আমার ছোটদাদা। দেশের খবর কি বল? আমার কথার সাথে একমত বা দ্বিমত করতেন। তর্ক-বিতর্ক হতো। কথায় আটকাতে না পারলে বলতেন- দাদা যে তোকে কি বানিয়েছে!
উল্লেখ্য যে, সাবেক ছাত্রলীগ এই নেতা ১৯৭৩-৭৪ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জিএস ছিলেন।
বৈজ্ঞানিক সমাজন্ত্রে বিশ্বাসি মানুষ’টি স্বপ্ন দেখতেন- কর্মমূখী-সৃজনশীল-কারিগরি-দূরশিক্ষণ শিক্ষার মাধ্যমে বেকারমুক্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ কিভাবে বিনির্মাণ করা যায়। ভাবতেন কিভাবে স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষ পেতে পারে। এদেশের ডিজাইন ও সাংস্কৃতিক শিক্ষায় অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি।
মানুষ স্বপ্নের চেয়েও বড়। কোন স্বপ্নই বৃথা যায় না। একটি স্বপ্ন থেকে জন্ম নিবে সহস্র স্বপ্ন। দেশ গড়তে জন্ম নিবে হাজারও শান্ত। সেই প্রজন্মই বিনির্মাণ করবে শহীদের চেতনার স্বপ্নের বাংলাদেশ। সেদিন সবাই প্রাণ খুলে হাসবে। একসাথে বাঁচবে।
প্রিয় পিতা,
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
আপনার সন্তানরাই গড়ে তুলবে আপনার স্বপ্নের নয়া বাংলাদেশ।
লেখকঃ সম্পাদক, কবিতা’অলা